বাংলাদেশ বিজনেস ক্লাইমেট ইনডেক্স বা ব্যবসা জলবায়ু সূচকের (বিবিএক্স) সর্বশেষ জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়, সূচকে সামান্য অগ্রগতি দেখা গেলেও সামগ্রিক অবস্থা এখনো ‘গুরুতর প্রতিবন্ধকতাপূর্ণ’। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, বৈশ্বিক অস্থিরতা, উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি, মূল্যস্ফীতি, সুদের হার বৃদ্ধি, মুদ্রা বিনিময়ের অস্থিতিশীলতা ও বিনিয়োগে অনিশ্চয়তা— সব মিলিয়ে ব্যবসা পরিবেশ এখনো সেই আগের মতই ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে।
বৃহস্পতিবার রাজধানীর এমসিসিআই গুলশান কার্যালয়ে ‘বাংলাদেশ বিজনেস ক্লাইমেট ইনডেক্স (বিবিএক্স) ২০২৪-২৫’ প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। অনুষ্ঠানে বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন।
বিবিএক্স জরিপের ফল প্রকাশ করেন পলিসি এক্সচেঞ্জের নির্বাহী চেয়ারম্যান ও সিইও ড. মাশরুর রিয়াজ। অনুষ্ঠানে প্যানেল আলোচনায় অংশ নেন বাংলাদেশ চেম্বারের (বিসিআই) সভাপতি আনোয়ার-উল-আলম চৌধুরী পারভেজ এবং বার্জার পেইন্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রূপালি চৌধুরী, জেট্রোর কান্ট্রি রিপ্রেজেন্টেটিভ কাজুআকি কাটাওকা। উপস্থিত ছিলেন এমসিসিআই সভাপতি কামরান টি রহমান।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন বলেন, ব্যাংক ঋণের উচ্চ সুদহার ব্যবসার জন্য প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে যা আগামী বছর নাগাদ সুদহার কমে আসতে পারে।
বাণিজ্য উপদেষ্টা আরও বলেন, ব্যবসা সহায়ক পরিবেশের আরেকটি বাধা দুর্নীতি। পৃথিবীর সব দেশেই ?দুর্নীতি আছে। তবে দৃঢ় নজরদারি ও স্বাধীন প্রতিষ্ঠান গড়ে তুললে এটি অনেকাংশে কমানো সম্ভব। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন যে কোনো দুর্নীতির অভিযোগ সরাসরি তাকে জানানোর আহ্বান জানিয়ে শেখ বশিরউদ্দীন বলেন, সরকার ব্যবসায়ীদের অভিযোগগুলো গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করবে।
অনুষ্ঠানে পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ও সিইও ড. মাশরুর রিয়াজ বলেন, বাংলাদেশের ব্যবসা পরিবেশে গত এক বছরে বড় কোনো অগ্রগতি হয়নি; বরং কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের তথ্যপ্রাপ্তি, অবকাঠামো, শ্রমনীতি, বাণিজ্য সুবিধা, প্রযুক্তি গ্রহণ, পরিবেশগত মান রক্ষা-এসব ক্ষেত্রে আগের বছরের তুলনায় সূচকের মান কমেছে। তবে সামগ্রিকভাবে দেশের ব্যবসা পরিবেশ সূচক ৫৯.৬৯ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে, যা আগের অর্থবছরের ৫৮.৭৫ পয়েন্ট থেকে সামান্য বেড়েছে। মাত্র ০.৯৪ পয়েন্ট বৃদ্ধিকে বিশেষ কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন হিসাবে দেখা যাচ্ছে না। তিনি আরও বলেন, রাজনৈতিক অস্থিরতা, ভূরাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি, বিনিয়োগে অনিশ্চয়তা, মুদ্রাস্ফীতি, ব্যাংকের সুদহার বৃদ্ধি ও মুদ্রা বিনিময় হারের অস্থিরতা-এসবই বাংলাদেশের ব্যবসা পরিবেশকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে। ব্যবসা পরিবেশ উন্নয়নে এখনই এসব ক্ষেত্রে সংস্কারমূলক পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।
এমসিসিআই সভাপতি কামরান টি. রহমান বলেন, বিবিএক্স বাংলাদেশের অর্থনৈতিক বাস্তবতা প্রতিফলিত করে। নীতিনির্ধারক ও বিনিয়োগকারীদের জন্য এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ রেফারেন্স। তিনি আর্থিক অন্তর্ভুক্তি, ডিজিটালাইজেশন, অবকাঠামো উন্নয়ন, দক্ষতা বৃদ্ধি ও প্রশাসনিক সক্ষমতা বাড়ানোর ওপর জোর দেন।
বিসিআই সভাপতি আনোয়ার-উল-আলম চৌধুরী পারভেজ বলেন, আমলাতান্ত্রিক সহযোগিতার ঘাটতি এখন বড় সমস্যা। অনেক কর্মকর্তা দায়িত্বহীনভাবে কাজ করছেন, যা ব্যবসার পরিবেশকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ছাড়া বিনিয়োগ ও প্রতিযোগিতা বাড়ানো সম্ভব নয়।
ফরেন চেম্বারের সাবেক সভাপতি ও বার্জার পেইন্টস বাংলাদেশ লিমিটেডের এমডি রূপালি চৌধুরী বলেন, ব্যবসায়ীদেরও আইন ও বিধি মেনে চলতে হবে। অনেক প্রতিষ্ঠান বছর বছর লোকসান দেখানোর কারণে ন্যূনতম কর আরোপ করতে হয়েছে। স্বচ্ছতা ও অটোমেশনই টেকসই উন্নয়নের পথ।
বিবিএক্সজরিপে ১১টি সূচকের ভিত্তিতে ব্যবসা পরিবেশ মূল্যায়ন করা হয়। এগুলো হলো— ব্যবসা শুরু, জমির প্রাপ্যতা, আইন ও বিধির তথ্যপ্রাপ্তি, অবকাঠামো সুবিধা, শ্রম নিয়ন্ত্রণ, বিরোধ নিষ্পত্তি, বাণিজ্য সহজীকরণ, কর পরিশোধ, প্রযুক্তি গ্রহণ, ঋণের প্রাপ্যতা এবং নতুনভাবে যুক্ত হওয়া পরিবেশগত নিয়ন্ত্রণ ও মান সূচক।
ব্যবসায়ীদের শীর্ষস্থানীয় সংগঠন মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এমসিসিআই) ও বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের (পিইবি) যৌথ গবেষণায় এই ইনডেক্স তৈরি করা হয়েছে। উদ্যোগটিকে সহায়তা করেছে অস্ট্রেলিয়ান সরকারের ডিপার্টমেন্ট অব ফরেন অ্যাফেয়ার্স অ্যান্ড ট্রেড (ডিএফএটি)।
0 মন্তব্যসমূহ