উৎসবে সাজুন, তাতে ক্ষতি নেই। তবে সাজ যেন উৎপাতে না বদলে যায়, সে দিকে খেয়াল রাখতে হবে। রোজের ভুলে ত্বকের নানা সমস্যা ও তার সমাধানের উপায় বাতলে দিলেন ত্বক চিকিৎসক কৌশিক লাহিড়ী।
ফেশিয়াল করার পরে সমস্যা অনেকেরই হয়। প্রথম বার যিনি ফেশিয়াল করতে গিয়েছেন অথবা এমন কোনও ফেশিয়াল করিয়েছেন, যা আগে কখনও করাননি, তাঁর হয়তো দেখা গেল কিছু দিন পর থেকেই সারা মুখে ছোট ছোট লালচে দানার মতো বেরিয়ে গেল। অথবা ত্বক শুকিয়ে খসখসে হয়ে গেল। জেল্লা তো বাড়লই না, উল্টে জ্বালা-চুলকানিতে ভোগান্তি সপ্তমে উঠল। তখন ওষুধ লাগাও, চিকিৎসের কাছে যাও, হাজারো ঝক্কি। ত্বকের পরিচর্যা অবশ্যই করবেন, তবে সাবধানে। কম সময়ে তারকাদের মতো জেল্লাদার ত্বক পেতে এখনকার ছেলেমেয়েরা এমন সব প্রসাধনী ব্যবহার করেন অথবা সালোঁতে গিয়ে এমন কিছু ফেশিয়াল বা ত্বকের থেরাপি করান, যা হয়তো আদৌ তাঁদের জন্য নিরাপদ নয়। এর থেকেই নানা সমস্যার সূত্রপাত হয়। শুরুতে বোঝা যায় না। কিছু দিন পর থেকে ত্বকের এমন সব সমস্যা শুরু হয়, যা সহজে সারে না। বরং দীর্ঘমেয়াদে নানা চর্মরোগের কারণ হয়ে ওঠে।
উৎসবে সাজুন, তাতে ক্ষতি নেই। তবে সাজ যেন উৎপাতে না বদলে যায়, সে দিকে খেয়াল রাখতে হবে। এই যে ফেশিয়ালের উদাহরণ দেওয়া হল, তার থেকে ত্বকের যে সব সমস্যা দেখা দেয় তার নাম ‘ইরিট্যান্ট কনট্যাক্ট ডার্মাটাইটিস’। অনেকেই ভোগেন এতে। ফেশিয়াল, হেয়ার ডাই, লিপস্টিক, সাবান, আফটার শেভ লোশন থেকে হতে পারে এই ধরনের চর্মরোগ। আরও নানা সমস্যা রোজের জীবনে দেখা দেয়। ছোট্ট উদাহরণ দিই। সুগন্ধি সকলেই ব্যবহার করেন। তবে তা আপনার ত্বকের জন্য ভাল কি না, তা ভেবে দেখেছেন কি? এমন অনেকে আছেন, যাঁদের সংগ্রহে নামী ব্র্যান্ডের বহুমূল্য দেশি-বিদেশি সুগন্ধি আছে। সেগুলি প্রয়োজনের অতিরিক্ত ব্যবহার করেন। যতটা পাল্স পয়েন্টে না মাখলেই নয়, তার চেয়ে বেশি সারা ত্বকে, জামাকাপড়ে মেখে ফেলেন। এর ফল হয় ভয়ঙ্কর। হয়তো আপনার সহকর্মী বা বন্ধুবান্ধব সেই সুগন্ধে মুগ্ধ হচ্ছেন ঠিকই, তবে তা আপনার ত্বকের জন্য বিষাক্ত হয়ে উঠছে। অতিরিক্ত সুগন্ধি থেকে যে চর্মরোগ হতে পারে, তার নাম ‘অ্যালার্জিক কনট্যাক্ট ডার্মাটাইটিস’। কানের পিছনে, হাতে লালচে র্যাশের মতো দেখা দেবে। আপনি মনে করবেন, গরমে ঘামাচির মতো হচ্ছে। কিন্তু পরে তা থেকেই ত্বকে বড় বড় ফোস্কার মতো দেখা দেবে, যা সহজে সারতে চাইবে না।
চুলে ডাই কমবেশি সকলেই করেন। এখনকার ছেলেমেয়েরা চল্লিশের আগেই নানা রকম ডাই করা শুরু করেন। কেউ কেউ নিত্যনতুন রং বদলান। এ মাসে লালচে-খয়েরি রং, তো পরের মাসে সোনালি হাইলাইট। এতে চুল পড়া, অকালে চুল পেকে যাওয়ার সমস্যা তো বাড়েই, উল্টে চর্মরোগও দেখা দেয়। অনেকেরই হেয়ার ডাই করার পরে ঘাড়ে ও কানের পিছনে র্যাশ, চোখে সংক্রমণ দেখা দিয়েছে। এই অসুখগুলি খুবই খারাপ। নানা রকম কসমেটিক ব্যবহার করে এদের রীতিমতো নিমন্ত্রণ করে আনা হচ্ছে।
আরও একটি সমস্যা দেখা দেয়, যার নাম ‘ফোটো কনট্যাক্ট’। প্রসাধনীর রাসায়নিকের সঙ্গে মেশে রোদ। আপনার অলক্ষেই ঘটে যায় নানা ক্রিয়া-বিক্রিয়া। ফলস্বরূপ দেখা দেয় ‘ফোটো ইরিট্যান্ট’ বা ‘ফোটো অ্যালার্জিক ডার্মাটাইটিস’। অনেকটা সানবার্নের মতোই। ত্বকে পুড়ে যাওয়া বা ঝলসে যাওয়ার মতো দাগ দেখা দেয়। তার উপর র্যাশ, চুলকানিও হয়। একে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় বলে ‘ফোটোটক্সিক প্রতিক্রিয়া’। এই অসুখ দীর্ঘ সময় ভোগায়।
শরীর যেমন ভাল রাখবেন, তেমন ত্বকের সুস্থতাও জরুরি। তার জন্য পরিচর্যাও দরকার। তবে ঘরোয়া উপকরণে পরিচর্যা অনেক বেশি স্বাস্থ্যকর। বাজারচলতি নানা রকম প্রসাধনী যতই লোভনীয় মনে হোক না কেন, এগুলির ফাঁদে পা দিলেই বিপদ। তার উপর এখন সমাজমাধ্যমে রূপ-লাবণ্য বৃদ্ধির যে সব টোটকাগুলি বলা হয়, সেগুলি আরও মারাত্মক। কেউ বলেন, মুলতানি মাটির সঙ্গে দুধের সর ও একটি বিশেষ ট্যাবলেট বা জড়িবুটি মিশিয়ে মাখলেই ত্বক ঝলমল করবে। কারও নিদান, থানকুনি পাতার সঙ্গে তাঁদের সংস্থার তৈরি বটিকাটি মিশিয়ে খেলেই চুল পড়া বন্ধ হবে। এই সব প্রচারে বিশ্বাস করে তা করতে গেলেই সমস্যায় পড়বেন।
কী কী করবেন না?
দোকান থেকে যে কোনও প্রসাধনী কেনার আগে লেবেলটি ভাল করে পড়ুন। জানুন, কী কী উপাদান আছে তাতে। কোনগুলিতে আপনার অ্যালার্জি, তা যাচাই করে নিন।
যে কোনও প্রসাধনী কেনার পরে তা সরাসরি মুখে বা হাতে মাখবেন না। আগে কিছু দিন কানের পিছনে বা কনুইয়ের কাছে লাগিয়ে দেখুন। অন্তত ১২-২৪ ঘণ্টা দেখতে হবে, ত্বকে কোনও প্রতিক্রিয়া হচ্ছে কি না।
ত্বকের কোনও ঘা, র্যাশ বা প্রদাহের উপর প্রসাধনী লাগাবেন না।
ত্বকের উপর সরাসরি সুগন্ধি স্প্রে করবেন না।
ভিটামিন ‘এ’ বা ‘ই’ মেশানো ক্রিম বিশেষ উপকারী নয়। এগুলি ত্বকের জেল্লা ফেরাতে পারে না। তার জন্য ডায়েট ও ঘরোয়া উপায়ে পরিচর্যা প্রয়োজন।
কোনও ক্রিম মেখে ত্বকের ঔজ্জ্বল্য বিশাল বাড়িয়ে ফেলা যায় না।
চিকিৎসকের পরামর্শ না নিয়ে মুখে কখনও স্টেরয়েড জাতীয় ক্রিম মাখবেন না।
শিশুদের চোখে ভুলেও কাজল পরাবেন না, এতে চোখের ক্ষতি হয়।
(লেখক একজন ত্বক চিকিৎসক)
0 মন্তব্যসমূহ